বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ানের সংক্ষিপ্ত জীবনী
Shagatom Chakma
চুনিলাল দেওয়ান বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম চিত্রশিল্পী এবং চাকমা আধুনিক কবিতার প্রথম লেখক। অনন্য প্রতিভার অধিকারী চুনিলাল দেওয়ান একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, কবি, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সাথে যৌথভাবে বিখ্যাত “জলপ্রপাত” ছবিটি অংকন করেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ান ১৯১১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী তাঁর পৈত্রিক কর্মস্থল পার্বত্য চট্টগ্রামের দিঘীনালায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে চুনিলাল দেওয়ানের নিবাস নান্যাচর উপজেলায় চেঙ্গী বড়াদাম, ৬১ নং মাইছছড়ি মৌজায়। তাঁর পিতা শশী কুমার দেওয়ান তৎকালীন দিঘীনালা থানার ভারপ্রাপ্ত-কর্মকর্তা পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মাতার নাম নয়নতারা দেওয়ান। চুনিলাল দেওয়ান মলিমা গোজা, ধাবানা গোষ্ঠীর লোক ছিলেন। কালিন্দী রাণীর রাজত্বের অবসানের সাথে সাথে ধাবানা গোষ্ঠীর রাজত্বকাল শেষ হয়। চুনিলাল দেওয়ান এই মলিমা গোজা ধাবানা গোষ্ঠীর ১৬ তম প্রজন্মের।

শিক্ষাজীবন:
শৈশবে মাতৃহারা চুনিলাল দেওয়ান নান্যাচর এম. ই. স্কুল থেকে পড়ালেখা শুরু করেন। তারপরে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নের পরে তাঁর শিক্ষা সমাপ্তি ঘটে। তিনি ১৯২৭ সালে গভর্মেন্ট স্কুল অব আর্টস, চৌরঙ্গী, কলকাতায় ১ম বর্ষে ভর্তি হন। সেসময় তিনি টুঙ্গী বৌবাজারে (বর্তমানে বিজন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট) একটি মেসে থাকতেন। পরবর্তীতে চুনিলাল ১৯২৮ সালে কলকাতায় “কলকাতা আর্টস স্কুল”-এ ভর্তি হন। দীর্ঘ ৬ বৎসর অধ্যয়ন করে ১৯৩৪ সালে আর্টস এন্ড ক্রাপ্ট কমার্শিয়াল বিভাগে ডিগ্রী লাভ করেন।
বিবাহ:
চুনিলাল দেওয়ান প্রথমে আনন্দ মোহন দেওয়ানের কন্যা শ্রীমতি চারুবালা দেওয়ানকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি বসুন্ধরা দেওয়ানকে বিয়ে করেন। বসুন্ধরা দেওয়ান ছিলেন “কর্ণফুলি কান্না”-র মূল সূত্রকারী। বসুন্ধরা দেওয়ানকে ১৯১১ সালে আদিবাসী ফোরাম, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা মরনোত্তর সম্মাননা পদক দিয়ে ভূষিত করে।
কর্মজীবন:
চুনিলাল দেওয়ান ১৯৪৬ সালে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ড্রয়িং শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং মাত্র ২ বৎসর এ পদে তিনি বহাল ছিলেন। চুনিলাল দেওয়ান দুটি মৌজার হেডম্যান ও একটি বাজারের বাজার চৌধুরী ছিলেন। চুনীলাল দেওয়ান চিত্রকলাকে উপার্জনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তাঁর চিত্র কর্মে গানে ও কবিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী এবং বৈচিত্র্যময় দৃশ্য ফুটে উঠে। তিনি রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর চিত্র কর্মের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন এবং শিল্প রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি (২ মে,১৯৩১ সন), কুমিল্লার কমিশনার (১৫ মে,১৯৪৪), পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি লে কর্ণেল জে এ হিউম (৪ নভেম্বর,১৯৫২) তাঁর চিত্রকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। চুনিলাল দেওয়ান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সাথে যৌথভাবে বিখ্যাত “জলপ্রপাত” ছবিটি অংকন করেন।

চুনিলাল দেওয়ান কলকাতা আর্টস কলেজে পড়াকালীন সময়ে ভাস্কর কাজে দক্ষতা লাভ করেন। তাঁর ভাস্কর্য কর্মের নিদর্শন নানিয়াচরে খুল্যাংপারা বৌদ্ধ বিহারে তিনটি বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। এছাড়াও তাঁর নিজের তৈরি সিমেন্টের একটি বিরাট মূর্তি ও কাঠের উপর খুদিত বুদ্ধ ও আনন্দের একটি ভাস্কর্য বর্তমানে নানিয়াচর থানার ‘বিশ্বলতা জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহার’ এ আছে বলে জানা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রথম সাময়িক পত্র “গৈরিকা”-র প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (এপ্রিল-মে ১৯৩৬। চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ানের আঁকা সুদৃশ্য প্রচ্ছদপট প্রথম সংখ্যা গৈরিকার প্রধান আকর্ষণ ছিল। প্রথম বর্ষে গৈরিকা দু’সংখ্যা প্রকাশিত হয়। চুনিলাল দেওয়ান চাকমা ভাষায় প্রথম আধুনিক কবিতা রচনা করেন। গৈরিকা-য় একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যায় চুনিলাল দেওয়ানের চাকমা কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটি চাকমা ভাষায় লিখিত প্রথম আধুনিক কবিতা যা রাজমাতা বিনীতা রায়-এর করা বঙ্গানুবাদসহ ছাপানো হয়েছিল। তাঁর কাব্য রচনার একটি বিশেষ দিক ছিল তিনি অনেকাংশে ধর্মীয় চেতনার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। চিরন্তন প্রেম কথা ও নির্মল নিসর্গপ্রীতি ছিল তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। ১৯৮০ সালে রাঙ্গামাটি সাহিত্যাঙ্গনের নবম প্রকাশনায় অধ্যাপক নন্দলাল শর্মার সম্পাদিত “নিবেদন” নামে একটি সংকলনে চুনীলাল দেওয়ানের ৩২ টি গান ও কবিতা প্রকাশ করা হয়। চুনীলাল দেওয়ান হারমোনিয়াম, পিয়ানো, বাঁশী, সেতার বাজানোতেও দক্ষ ছিলেন। সেতার বাজিয়ে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোরঞ্জন করেছিলেন বলে জানা যায়।

১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর সরকারী খরচে চুনিলালের যুক্তরাজ্য যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। সে বছরের ৮ই ডিসেম্বর ‘ফুড পয়জনিং’ এর শিকার হয়ে তিনি সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটে নিজ বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চুনিলাল দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের হৃদয়ে তাঁর চিত্রকর্ম, কবিতা, গানের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে বেচে থাকবেন। চিত্রশিল্প জগতের অনন্য প্রতিভার অধিকারী চুনিলাল তাঁর কাজের মাধ্যমে যে আলো দেখিয়েছেন, সে আলো পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন প্রজন্মকে শিল্পজগতে পা রাখতে সাহস এবং অনুপ্রেরণা জোগাবে।
তথ্যসূত্র:
১। আলোর পথ দেখালো যারা – প্রমোদ বিকাশ কার্বারী
২। চুনিলাল দেওয়ান আমাদের গর্ব ও প্রেরণা- প্রতিম দেওয়ান
2,340 total views, 2 views today
Pingback: আমাদের গর্ব চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ান – ড়ুভাগা ব্লগ-