কাপ্তাই বাঁধ: বর-পরং, ডুবুরীদের আত্মকথন- গ্রন্থ পর্যালোচনা
কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের উন্নয়নের চাকায় পিষ্ট হয়ে তছনছ হয়ে যাওয়া ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর জবানীতে “কাপ্তাই বাঁধ বর-পরং ডুবুরীদের আত্মকথন” গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে তৈরি হওয়া কৃত্রিম হ্রদ কারো কাছে স্রেফ বিনোদন, আমোদ-ফূর্তির জায়গা হলেও এই হ্রদ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠী বিশেষত চাকমা জনগোষ্ঠীর কাছে “বর-পরং” এর হাহাকার তুলে ধরে। “বর-পরং” শব্দটি গ্রন্থে ভুক্তভোগীদের জবানীতে কাপ্তাই বাঁধের ফলে বসত-ভিটা ডুবে যাওয়া উদ্ভাস্তু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দেশান্তর, তথা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নেফায় (বর্তমান অরুনাচল প্রদেশ) চলে যাওয়ার অজানা ইতিহাসকে তুলে ধরে। লেখিকা তার গ্রন্থে স্মৃতিকথা ব্যক্ত করা ভুক্তভোগীদের ডুবুরী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যারা কাপ্তাই বাঁধের পানিতে ডুবে যাওয়া ভিটে-মাটি, শৈশব, পরিবার, আত্মীয়ের সুখ স্মৃতি এবং হারানো গভীর ক্ষত আরেকবার ডুবুরীর মতো হ্রদের স্বচ্ছ জলে খুঁজে ফিরেছেন। একই পরিবারের একাংশ চলে গেছে বর-পরংয়ে, অপর অংশ রয়ে গেছে বাংলাদেশে। পরিবারের এ পাড়ের অংশ জানে না অপর পাড়ের অংশ কেমন আছে, অন্যদিকে অপর পাড়ের অংশ জানে না, এ পাড়ের পরিবার কেমন আছে। অনিশ্চয়তায় পূর্ণ জীবনের গল্প, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সমাজে নারীর অবস্থান, বর-পরংয়ের ইতিহাস লেখিকা সমারী চাকমা তার গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।

“কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প” ব্রিটিশ শাসনামলে পরিকল্পিত হলেও মূলত পাকিস্তান শাসনামলে তার বাস্তবায়ন ঘটে। প্রথমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধটি বরকলের চিলোক-ধাক নামক স্থানে নির্মানের প্রস্তাব করা হলেও তা পরবর্তীতে বর্তমান স্থানে কাপ্তাইয়ের চিংমরংয়ে (চিৎমরম) নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় চুয়ান্ন হাজার একর জমি এবং প্রায় ১৮০০ পরিবারের (জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ১ লাখ) ভিটে-মাটি পানিতে তলিয়ে যায়। এক লাখ জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ ভারতে বর-পরংয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

তাদের মধ্যে পাঁচ জন নারী এবং পাঁচ জন পুরুষের জবানীতে কাপ্তাই বাঁধ পূর্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের গোলাভরা ধান, ফলের বাগান, বিদ্যালয়, মন্দির, ডুবে যাওয়া চাকমা রাজবাড়ীর ইতিহাসসহ নানা ঘটনা গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। হেঁসে-খেলে কাটানো তাদের নিষ্পাপ শৈশব, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ভুক্তভোগীদের জবানীতে পাঠককে যেমন কল্পনার সুখ-সাগরে ভাসায় তেমনি কাপ্তাই বাঁধের জলে ডুবে যাওয়া সহায়-সম্বল, ভিটে-মাটির হাহাকার পাঠককে ভারাক্রান্ত করে তোলে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে বিশ্বাস অবিশ্বাসের খেলায়, একদিন তারা সত্যিকার অর্থেই বুঝতে পারে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ হতে চলেছে। তাদের মধ্যে বসত-ভিটা, গড়ে তোলা বাগান সবকিছু ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা চলতে থাকে। সরকার জায়গার শ্রেণি হিসেবে ক্ষতি পূরণ দিয়েছে; তা অবশ্য কেউ পেয়েছিল আবার কেউ পায় নি। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুধু জন-জীবনে ক্ষত তৈরি করে নি , হাজারো প্রাণ-প্রকৃতিতে আঘাত হেনেছে তা কুকুর-বিড়ালের কান্নার রোল কিংবা পশুপক্ষীর ক্রন্দনের চিত্রে ভুক্তভোগীদের জবানীতে উঠে এসেছে। বসত-ভিটা একসময় পানিতে ডুবে যেতে থাকলে স্থিতিশীল নব-জীবনের সন্ধানে উদ্ভাস্তু হওয়া মানুষ কাজলং রিজার্ভ ফরেস্ট, ফেনী, খাগড়াছড়ির দিকে নৌকা নিয়ে ছুটতে থাকে। সরকার পুনর্বাসন হিসেবে পরিবারের সদস্য প্রতি মাত্র এক একর জায়গা বরাদ্দ দেয়, অথচ কাপ্তাই বাঁধের জলে বসত-ভিটা ডুবে যাওয়ার আগে তাদের পরিবারের শত শত একর জমি ছিল। নতুন জায়গায় বাঘ, সাপ, হাতির ভয়ের শ্বাপদ সংকুল পরিবেশে শুরু হয় নিজেদের জীবন মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম। অন্যদিকে তাদের ডুবে যাওয়া পুরোনো বসত-ভিটার স্মৃতি দু’চোখের জলে ঝলমল করতে থাকে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে একপর্যায়ে হাজারো জুম্ম স্থিতিশীল জীবন লাভের আশায় ভারতের ডেমাগ্রীর উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। ফলে একই পরিবারের কিংবা আত্মীয়দের এক অংশ ভারতে এবং অপর অংশ বাংলাদেশে (তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান) থেকে যায়। পরিবারের দুই অংশ, দুই দেশে পাড়ি জমানোতে তাদের দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। তাদের অনেক জনকে ভুক্তভোগীরা জীবনের শেষ দেখা পায় নি আবার অনেকের সাথে পঁচিশ বছর বাদে যখন দেখা হয়, একে অপরকে চেনার মুশকিলে তাদের মধ্যে ভালোবাসা, ক্ষত বয়ে বেড়ানোর দীর্ঘশ্বাসের কান্না ফুটে উঠে। চাকমারা মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্য বসতি গড়ার চেষ্টা করলেও তাদের নেফায় (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ) নেওয়া হয়। গ্রন্থে ভুক্তভোগীর জবানীতে ২২ টি গ্রুপের কথা উঠে এসেছে, গ্রুপ করে উদ্ভাস্তু চাকমা জনগোষ্ঠীকে নেফায় নিয়ে যাওয়া হয়। দিনের পর দিন হাঁটার কষ্টে অনেক শিশু-বৃদ্ধ রাস্তায় মারা যায়, যাদের অনেক জনকে মাটিতে পুঁতে ফেলার সময়টুকু পর্যন্ত হয় নি। জীবনের কফিনে শেষ পেরেক টুকে দেওয়ার আগে স্থিতিশীল নব-জীবনের সন্ধানে ভারতের মাটিতে পা রাখলেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম কমেনি, বরং বেড়েছে। নেফা’র হীম-শীতল পরিবেশে ঠিকে থাকতে হয়েছে। অন্যদিকে অনেক গ্রুপ নেফা’র শীতল পরিবেশের কথা জানতে পেরে শিবির থেকে পালিয়ে ত্রিপুরা-মিজোরাম রাজ্য চলে আসে। সবকিছু হারিয়ে বর-পরং যাত্রা শেষ হলেও তারা নেফা’য় এখনো নাগরিকত্ব লাভ করে নি অধিকন্তু মৌলিক মানবাধিকার থেকে বছরের পর বছর তারা বঞ্চিত রয়েছে।
লেখিকা কাপ্তাই বাঁধের ভুলে যাওয়া ইতিহাস নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে তুলে ধরে যে সেতু বন্ধন তৈরি করেছেন তা পাঠকদের লেখিকার প্রতি ঋণী করে তুলেছে। ভুক্তভোগীদের জবানীতে ইতিহাস তুলে ধরে লেখিকা সমারী চাকমা তার গ্রন্থে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রন্থে কিছু বাক্য বিভ্রাট বা শব্দ বিভ্রাট রয়েছে, পাঠক হিসেবে আশা রাখছি পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধনে প্রকাশক নজর দিবেন। বর-পরংয়ের ডুবুরীদের আত্মকথা, তাদের দীর্ঘশ্বাস গ্রন্থে তুলে ধরে ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উন্মোচনে গ্রন্থটি স্বার্থকতা লাভ করেছে।
Book Review by Shagatom Chakma
2,741 total views, 12 views today
বইটি কোথায় পাওয়া যাবে?
আমার বইটি রিভিউ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।