নিকোলা টেসলা: শতাব্দীর সেরা কিংবদন্তী এক বিজ্ঞানী
Pavel Chakma
আমাদেরকে যদি বিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বলা হয়, তাহলে আমরা খুব কম সময়েই নিউটন, টমাস আলভা এডিসন,গ্যালিলিও কিংবা স্টিফেন হকিংয়ের নাম বলে ফেলি। কেননা এইসকল বিজ্ঞানী আমাদের কাছে অধিক পরিচিত। তবে একজন বিজ্ঞানী আছেন যিনি এদের থেকে কম অবদান না রাখলেও এদের মত তেমন পরিচিতি পান নি। হ্যা,নিকোলা টেসলার কথাই বলছি।

১৮৫৬ সালের ১০ই জুলাই সার্বিয়ায়(বর্তমানে ক্রোয়েশিয়া ) জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, টেসলার জন্মের সময় প্রচন্ড বজ্রসহ ঝর হওয়ায় ধাত্রী টেসলাকে অশুভ বলে মনে করেন। এতে তার মা প্রত্যুত্তরে জানান, ‘এই ছেলেই পৃথিবীতে আলো নিয়ে আসবে’। টেসলা তার পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে ৪র্থ ছিলেন। টেসলার পিতা ছিলেন ধর্মযাজক এবং মা গৃহিণী। টেসলার পিতা চাইতেন টেসলা যেন তাঁর মতো ধর্মযাজক হয়। টেসলার মায়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও তিনি অবসর সময়ে নানা গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারতেন, যার মধ্যে এগ বিটার অন্যতম।
ছোটকাল থেকেই টেসলার অসামান্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। টেসলা মনে মনে ক্যালকুলাস সমাধান করে ফেলতে পারতেন, যা দেখে তার শিক্ষকদের মনে সন্দেহ আর বিস্ময় জেগেছিল। নিকোলা টেসলার ফটোগ্রাফিক মেমোরি ছিল যার কারনে তিনি অনায়সে পুরো বই মুখস্ত করে ফেলতেন। টেসলা ১৮৬১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি তাঁর মাধ্যমিকের ৪ বছরের পড়া ৩ বছরেই শেষ করেন। শেষ করার সেই বছরেই তিনি গ্রামে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হন। কলেরায় তাঁর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়েছিল যে তিনি প্রায় মৃত্যুর দুয়ারে চলে গিয়েছিলেন। সেই নিকটবর্তী মৃত্যুর সময়ে টেসলা তার বাবার কাছে আবদার করেন, তিনি যদি সুস্থ হন তবে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবেন এবং তার বাবা বাধ্য হয়ে এতে সম্মতি জানান। একসময় টেসলা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
১৮৭৪ সালে টেসলা সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পাহাড়,বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। এসময় তিনি মার্ক টোয়েনের প্রচুর বই পড়েন। এরপর ১৮৭৫ সালে টেসলা সেনাবাহিনীর একটি বৃত্তি লাভ করেন এবং অস্ট্রিয়ার গ্রাজ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষে তিনি প্রতিটি ক্লাসেই উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি ভোর ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত টানা পরিশ্রম করতেন। ১ম বর্ষের ফলাফলে তিনি সব বিষয়েই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন টেসলার বাবাকে তাঁর ছেলের ভাল ফলাফলের কথা লিখে পাঠান। টেসলার বাবা প্রফেসরকে একটি চিঠি পাঠান, এতে লেখা ছিল যে টেসলা হয়ত অধিক পরিশ্রম করলে মারা যেতে পারে। তাই অধিক পরিশ্রম করলে তাকে যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২য় বর্ষে টেসলা ডিসি মোটরের কিছু সম্ভাব্য ত্রুটি নিয়ে শিক্ষকের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং সে বছর জুয়ার প্রতি আসক্ত হওয়ায় তাঁর বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়। জুয়া খেলার প্রতি অত্যাধিক পরিমাণে আসক্ত হয়ে পড়ায় তাঁর একাডেমিক পড়া শিকেয় উঠেছিলো। চুড়ান্ত পরীক্ষা সন্নিকটে আসায় তার উপলব্ধি হয়, যে তিনি কিছুই পড়েন নি এবং শিক্ষকদের পিএল(Preparation Leave ) বাড়ানোর অনুরোধ করেন কিন্তু শিক্ষকরা এতে অসম্মতি জানায়। ফলে হয়ে গেলেন ড্রপ আউট।

ড্রপ আউট হওয়ার পর ১৮৭৮ এর ডিসেম্বরে পরিবারকে না জানিয়ে নিকোলা টেসলা স্লোভেনিয়াতে চলে আসেন যেন পরিবার তাঁর ড্রপআউটের খবর জানতে না পারে। সেখানে তিনি ৬০ ফ্লোরিনের বিনিময়ে ড্রাফটসম্যানের কাজ করতেন এবং বাকি সময় তাস খেলে কাটাতেন। ১৮৮১ সালে টেসলা বুদাপেস্টে চলে আসেন এবং সেখানে তিনি একটি টেলিফোন কোম্পানিতে চাকরি নেন। বুদাপেস্টে থাকাকালীন সময়েই তাঁর ইন্ডাক্সন মোটরের আইডিয়া আসে। একদিন বুদাপেস্টের এক পার্কে তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ করেই লাঠি দিয়ে মাটিতে ইন্ডাক্সন মোটরের ডায়াগ্রাম আঁকেন। এটি আবিস্কার করার জন্য অনেক বছর গবেষণা করে তিনি প্রায় হাল ছাড়ার উপক্রম হন। এরপর তিনি ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৮৪ সালের জুন মাসে টেসলা নিউইয়র্কে যাত্রা করেন। নিউইয়র্ক পৌছানোর সময় তার পকেটে শুধুমাত্র ৪ সেন্ট এবং বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভ এডিসনের কোম্পানির প্রাক্তন এক কর্মকর্তার রিকমেন্ডেশন লেটার ছিল যাতে লেখা ছিল যে,”প্রিয় এডিসন,আমি দুজন বিখ্যাত ব্যাক্তিকে চিনি যার একজন হল তুমি আর একজন হল তোমার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই যুবক”। এডিসন টেসলার সাথে তার কোম্পানি এবং তার করা নানা ইন্জিনিয়ারিং গবেষণা নিয়ে আলোচনা করার পর তাকে নিয়োগ দিলেন। এডিসন টেসলাকে প্রস্তাব দেন যে তিনি যদি এডিসনের ডিসি জেনাটরটিকে সম্পূর্ণ করতে পারেন তবে তিনি টেসলাকে ৫০ হাজার ডলার দিবেন।

অক্লান্ত পরিশ্রমে টেসলা ডিসি জেনারেটরটিকে সম্পূর্ণ করতে সফল হন। এরপর টেসলা তার পাওনা চাইলে এডিসন তাকে বিদ্রুপ করে বলেন যে,”তুমি তো দেখি আমেরিকার হিউমারও বোঝ না”।এডিসনের এহেন প্রতারণায় টেসলা তৎক্ষণাৎ চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই একটি কোম্পানি খুলে বসেন। টেসলা তার কোম্পানিতে সর্বপ্রথম একটি ইলেকট্রিক মেশিন কম্যুটেটর উদ্ভাবন করেন। এটিই ছিল তার প্রথম পেটেন্ট। কিন্তু টেসলার সেই উদ্ভাবনগুলোকে লাভজনক মনে না করায় কেউ বিনিয়োগ করতে চাইতেন না। অর্থাভাবে টেসলা আবার চাকরির সন্ধান করেন। টেসলার কাজ চলমান এসি মোটরের কথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এবং বিনিয়োগকারীরা এতে বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখান। এরপর একটি কোম্পানি টেসলাকে সেই এসি মোটর নিয়ে কাজ করার জন্য তাদের ল্যাবে নিয়োগ দেন,মজার ব্যাপার হল সেই ল্যাবটি এডিসনের অফিসের কাছাকাছি। ১৮৮৮ সালে টেসলা এসি কারেন্ট আবিষ্কার করতে সক্ষম হন,যেটিকে টেলিফোনের পর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে গন্য করা হয়। তিনি IEEE তে এটি প্রদর্শন করেন এবং সবাই এটির প্রশংসা করেন। টেসলা ৬০,০০০ ডলার দিয়ে এসি কারেন্টের পেটেন্ট করিয়ে নেন। শীঘ্রই এসি কারেন্টের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এতে এডিসনের মনে ভয় ঢুকে গেল যে এসি কারেন্ট বাজার পেয়ে গেলে তাঁর আবিষ্কৃত ডিসি কারেন্ট বাজারে মুখ থুবরে পড়বে। তাই তিনি এসি কারেন্টকে জনসাধারণের কাছে ক্ষতিকর প্রমান করার চেষ্টা করতে থাকলেন। কথিত আছে, এডিসন স্থানীয় ছেলেদের পার হেড ২৫ সেন্ট দেওয়ার বিনিময়ে তাদের জীবিত কুকুর বিড়াল আনার জন্য বলেন। এডিসন এসি কারেন্ট ক্ষতিকর প্রমাণ করার জন্য সেই কুকুর,বিড়ালগুলোকে এসি কারেন্টে শক দিয়ে জনসম্মুখে মেরে ফেলেন। এসি কারেন্ট শুধুমাত্র টেসলার মেধার প্রকাশের একটি অংশ। তিনি আরো নানা কিছু আবিষ্কার করেছেন। ২০ শতাব্দীর আগে টেসলা একটি শক্তিশালী কয়েল আবিষ্কার করেন যেটির হাই ভোল্টেজ ও ফ্রিকোয়েন্সী উৎপাদন করার ক্ষমতা ছিল। এই কয়েল পরবর্তীতে “টেসলা কয়েল” নামে পরিচিতি পায়।
টেসলা পরবর্তীতে লক্ষ্য করেন যে তার আবিষ্কৃত কয়েল রেডিও সিগনাল গ্রহণ ও পাঠাতে পারে। কিন্তু এই তথ্য ফাস হয়ে যাওয়ায় মার্কনি রেডিওর পেটেন্ট নেন এবং তিনিই রেডিওর জনক হিসেবে পরিচিতি পান। টেসলা এক্স রেও আবিষ্কার করেছিলেন কিন্তু সেটির কোন পেটেন্ট তিনি নেন নি। পরবর্তীতে রন্টজেন এই অদৃশ্য তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেন এবং এটির নাম এক্স রে দেন। এছাড়া টেসলা ওয়ারলেস কমিউনিকেশন নিয়েও কাজ করেন, যার বিবর্তিত রুপ আজকের যুগের ওয়াইফাই।

এছাড়াও টেসলা অনেককিছু আবিষ্কার করেন যার পেটেন্ট বা লাইসেন্স টেসলা করান নি যেমনঃট্রান্সফর্মার,ফ্লুরোসেন্ট বাতি,রাডার,হাইড্রো ইলেক্ট্রিক পাওয়ার ইত্যাদি। আবার টেসলা বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করেন যা মানবকল্যানের স্বার্থে নিজ হাতে ধ্বংস করে দেন যার মধ্যে রয়েছে Earthquake machine,Thought camera,Time machine,Death ray,Artificial tidal wave ইত্যাদি। আবার,অনেক বিজ্ঞানীর বহু আবিষ্কারে টেসলার পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। তবে মহান এই বিজ্ঞানীর বৃদ্ধজীবনও সুখের হয় নি। তার আবিষ্কৃত বেশিরভাগ জিনিসের মুল্য তিনি না পাওয়ায় তার শেষ বয়সও অর্থাভাবে কাটে। তিনি নিউইয়র্কের একটি হোটেলে তার বৃদ্ধ বয়সের দিন গুলো কাটিয়েছেন। তিনি “অবসেসিব কমপালসিব ডিসঅর্ডারে” আক্রান্ত হন।তবে তিনি তাঁর আবিষ্কার কার্যক্রম তখনও থামান নি। তাঁর শেষ কাজটি ছিল একটি টাওয়ার তৈরি করা যেখান থেকে সারা বিশ্বের মানুষ বিনামূল্যে ওয়ারলেস এনার্জি পাবে। একটি কোম্পানি এই টাওয়ারটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে না জেনে এটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করা হয়।১৯৪৩ সালেী ৭ই জানুয়ারি টেসলাকে তার বাসকৃত হোটেলের রুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
148 total views, 2 views today