মুন্ডা বিদ্রোহ ও বিরসা মুন্ডা

Shagatom Chakma:

কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ সহ যে সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহ ইংরেজদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল তারমধ্যে মুন্ডা বিদ্রোহ অন্যতম। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে সংগঠিত হয় এই ঐতিহাসিক মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৮৫-১৯০০)। ভারতের ছত্তিসগড়, রাঁচি অঞ্চলের বিপ্লবী নেতা বিরসা মুন্ডা। মুন্ডা আদিবাসীরা ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে রুখে দাড়িয়েছিল । বিরসা মুন্ডা তাঁর অনুগামীদের কাছে “ধরতি আবা বা জগৎ পিতা ” নামে পরিচিত ছিলেন। রাঁচির দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্ট এই বিদ্রোহকে মুন্ডা ভাষায় বলা হয়,“উলগুলান”, যার অর্থ প্রবল বিক্ষোভ

১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর রাঁচির উলিহাতু গ্রামে (বর্তমান ঝাড়খন্ড) বিরসা মুন্ডা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সুগানা মুন্ডা, মায়ের নাম করমি হাতু। ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবারে জন্ম বলে মুন্ডা প্রথা অনুযায়ী পিতা সুগানা ও মাতা করমি ছেলের নামা রাখেন “বিরসা”। বিরসা মুন্ডার প্রাথমিক পড়াশোনা জয়পাল নাগের সহায়তায় সালগা গ্রামে শুরু হয়। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে আরেকটি দিক ছিল  লুথারীয়, অ্যাংলিকান্ ও ক্যাথলিক মিশনগুলির আগমন। মিশনারি কর্মকান্ডের সঙ্গে শিক্ষার বিস্তার ঘটে। প্রাথমিক পড়াশোনার পরে বিরসা মুন্ডা জার্মান মিশন স্কুলে ভর্তি হতে গেলে স্কুলে তাঁকে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষা নিতে শর্ত দেয়া হয়। এই মিশন স্কুল গুলোর মূল লক্ষ্য ছিল যত সংখ্যক সম্ভব আদিবাসীদের খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা। ফলে বিরসা মুন্ডা হয়ে গেলেন বিরসা ডেভিড, পরবর্তীতে বিরসা ডাউদ। অবশ্য বিরসা কয়েকবছর পরে জার্মান মিশন স্কুল ত্যাগ করেন।

মিশনারী স্কুলগুলোর মাধ্যমে অনেক মুন্ডা খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টান মুন্ডাদের মধ্যে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি হয়। ফলে জাতিগত ঐক্য হ্রাস পায়। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর হতে উপমহাদেশে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। এরই সঙ্গে বাড়তে থাকে বলপূর্বক শ্রম বা বেথ বেগারি’ (beth begari) এর ঘটনা। একদিকে মুন্ডাদের মধ্যে খৃষ্ট ধর্ম আগমনে অসন্তোষ, জাতিগত বিভেদ অন্যদিকে  ১৮৯৪ সালে জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা এবং সাধারণ কৃষকদের জমি থেকে বঞ্চিত করতে পালামৌ, মানভুম, ছোটনাগপুর সহ বিভিন্ন বন এলাকায় সংরক্ষিত বন আইন (১৮৮২) পাশের ফলে ভূমি বিষয়ক অসন্তোষ মুন্ডা জনগোষ্ঠিদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দানা বাঁধতে থাকে।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং বিভিন্ন অলৌকিক চর্চায় বিশ্বাসী বিভক্ত মুন্ডাদের মধ্যে ঐক্য গড়তে বিরসা মুন্ডা মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে ঘোষণা করলেন নতুন এক ধর্মের, যার মূল ভিত্তি ছিল ‘একেশ্বরবাদী মুন্ডা’। নিজেকে ঘোষণা করলেন ভগবানের অবতার হিসেবে। দলে দলে মুন্ডা, ওঁরাও, খরাই নরনারীরা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে পরিচিত হন “বিরসাত” নামে। বিরসা মুন্ডা তাঁর অনুসারীদের কাছে “ধরতি আবা বা জগৎ পিতা” নামে পরিচিত হলেন। বিরসাতরা বিরসা মুন্ডার নামে গান বানালো “মুন্ডারাজ ফিরাবে তাই নতুন রাজার জন্ম হে”।

ব্রিটিশ সরকার বন আইন প্রয়োগ করে আদিবাসীদের ভারতের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিল। যে জঙ্গলের উপর ভরসা রেখে আদিবাসীরা জীবনযাপন করতেন, সেই অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো। যখন সরকার ছোটনাগপুরে বন দখল করার উদ্যোগ নিলো, সে সময় প্রতিরোধে জেগে উঠলো বিরসাত বাহিনী। বিরসা মুন্ডা কোচাং, সিনজুরি, লোঙ্গা, কালমার, কাটোই, বীরবাঙ্কী, কুরুঙ্গার মত বিভিন্ন জঙ্গল এলাকার হাজার হাজার আদিবাসী মানুষদের একত্রিত করেন এবং সবাই ২০ বছরের যুবক বিরসাকে তাদের নেতা নির্বাচিত করেন। নেতা হিসেবে বিরসার উত্থান জমিদার, মহাজন এবং মিশনারীদেরকে ভীত করে।  ফলে তারা বিভিন্ন অভিযোগ এবং চাপ প্রয়োগ করতে থাকে তার বিরুদ্ধে। হঠাৎ ১৮৯৫ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বরে বিরসা মুন্ডাসহ তার কিছু সহচর কে গ্রেপ্তার করে সরকার। দীঘ ২ বছরের জেলহাজত মেয়াদ শেষে ১৮৯৭ সালে মুক্তি দেওয়া হয় বিরসাকে। তার মুক্তির পরপরই ছোটনাগপুর এলাকায় গুটিবসন্ত প্রাদুর্ভাবের তৎবধি চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষে ত্রান সহায়তার কাজে তার রাতদিনের নিমগ্নতা তাকে অবিসংবাদিত নেতা বানিয়ে দেয়। দুর্ভিক্ষ পিড়িত এবং রোগগ্রস্ত মুন্ডারা তাকে নিয়ে মুক্তির নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করে। মুন্ডারা একত্রিত হয় নব উত্থান প্রস্ততির জন্য-শুরু হয় উলগুলান, মুক্তির মহাবিদ্রোহ। ১৮৯৯ সনের ২৪ ডিসেম্বর রাচি, সোনপুর, চাইবাসার মত গুরুত্বপুর্ন স্থানে একযোগে একত্রিত উত্থান শুরু হয় এবং পরে ব্যপক এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর জবাবে ব্রিটিশ সরকার পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য হাজার হাজার মুন্ডা তরুন-তরুনী তীর ধনুক, বর্শাসহ বিভিন্ন প্রকার ঐতিহ্যগত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেইল রাকাব পাহাড়ে সম্মিলিত হয়। ব্রিটিশ জেনারেল বিরসা মুন্ডা বাহিনির উপর গুলি করার নির্দেশ দিলে তারা তাদের ঐতিহ্যগত তীর এবং ধনুক দিয়ে সমুচিত জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাথে পেরে ওটা অনেক কঠিন ছিল। ফলে বারিসাত বাহিনী পরাজিত হয়। তাতেও ব্রিটিশ বাহিনী সন্তুষ্ট হয় নি। তারা নির্বিচারে মুন্ডা নারী এবং শিশুদের গুলি করে হত্যা করতে থাকে। বারিসাত বাহিনীর, মৃত্যুর এবং বর্বরতার খরব সম্পুর্নভাবে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। মৃত দেহ গুলো রাতারাতি গণকবরে পচানো হয় এবং বহু আহত বিদ্রোহীদের জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। ডোম্বরু পাহাড়ের নাম হলো “তপেড় বুরু বা লাশের পাহাড়”। ব্রিটিশ সরকার ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষনা করলেন বিরসাকে ধরে দেওয়ার জন্য।

ব্রিটিশ বাহিনি গ্রামের পর গ্রাম তল্লাসী চালাতে থাকে বিরসা মুন্ডাকে খুজে বের করার জন্য। বিরসা মুন্ডাকে না পেয়ে তার অনেক ঘনিষ্ট সহচরদের গ্রেপ্তার এবং হত্যা করে তাদের ঘরবাড়ি জালিয়ে পুড়িয়ে দেয় ব্রিটিশ বাহিনি। অনেক খোজা খুজির পর ব্রিটিশ বাহিনী বিরসা মুন্ডাকে চক্রধরপুরের যমকোপাই বনে  ৩ই মার্চ ১৯০০ সালে গ্রেপ্তার করে। চাইবাসা জেলে বিরসা মুন্ডাকে কারারুদ্ধ করা হয়। এলাকার আশে পাশের হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ তাদের বিরসা ভগবানকে এক নজর দেখতে ভিড় জমান চাইবাসা জেলে। জেল কর্তৃপক্ষ বলে, বিরসা কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কিন্তু বলা হয়, ফাঁসির প্রতিক্রিয়ায় আবার গণঅভুত্থান ঘটার সম্ভাবনা থাকায় তাকে বিষপানে হত্যা করা হয়। ৯ জুন ১৯০০ সনে বিরসা মুন্ডা রাঁচি কারাগারে শহীদ হন।

২০০৪ সালে বিরসা মুন্ডার জীবন নিয়ে “উলগুলান-এক ক্রান্তি” নামে একটি হিন্দী সিনেমা প্রকাশিত হয়। মহাশ্বেতা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস “অরণ্যের অধিকার” বিরসা মুন্ডার জীবন নির্ভর। ভারতীয় পার্লামেন্ট  হলে একমাত্র আদিবাসী নেতা হিসেবে বিরসা মুন্ডার ছবি রয়েছে।

বিরসার জন্ম নিয়ে আজো মুন্ডারা গান গায়—

হে ধরতি আবা! জন্ম তোমার চালকাদেতে ভাদ্র মাসে

অন্ধজনের চোখ মিলল ভাদ্র মাসে

চলো যাই ধরতি আবাকে দেখি

এ বড়ো আনন্দ হে, তাঁকে প্রণাম করি

আমাদের শত্রুদের তিনি হারিয়ে দিবেন ভাদ্র মাসে।

তথ্যসূত্রঃ

  1. https://www.outlookindia.com/website/story/opinion-remembering-birsa-munda-a-tribal-folk-hero-and-freedom-fighter/364269

2. https://sobbanglay.com/sob/birsa-munda/

3. https://garojournal.com/%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%B6-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%A8/

4. https://ritambangla.com/state/birsa-jayanti-and-munda-movement/

5. https://ghotona.com/personality/news/2018/10/20/98

 201 total views,  2 views today

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *