সেক্স এবং জেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য

Shagatom Chakma

সাধারণত সেক্স এবং জেন্ডার- এই দুটি শব্দের অর্থই আমরা লিঙ্গ বলে জানি। স্কুলে বাংলা ব্যাকরণ পড়ার সুবাদে আমাদের হয়তো সকলের “জেন্ডার” শব্দটির সাথে পরিচিতি রয়েছে, যেখানে আমরা জেন্ডার বলতে লিঙ্গ বুঝি এবং বিভিন্ন ধরণের লিঙ্গের ধারণা পেয়ে থাকি, যেমন- পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, ক্লিবলিঙ্গ ,উভয়লিঙ্গ। সাধারণত আমরা জেন্ডার বলতে একজন ব্যাক্তি সে নারী? নাকি পুরুষ? এই প্রপঞ্চ বুঝে থাকি, কিন্তু জেন্ডার নারী কিংবা পুরুষের কোনো প্রতিশব্দ নয়, এটি সামাজিক ভাবে নির্মিত কিংবা ব্যাক্তি নিজেকে মানসিকভাবে যে লিঙ্গের কাতারে অনুভব করে তা বোঝায়। সেক্স এবং জেন্ডার একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে সাহিত্য কিংবা উন্নয়ন কর্মকান্ডে জেন্ডার প্রত্যয়টি ভিন্ন ও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং দুটো শব্দেরই আলাদা ও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে।

সেক্স কি?

সেক্স হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে সৃষ্ট একজন ব্যাক্তির বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্নতা বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যর ভিত্তিতে একজন ব্যাক্তির স্বাতন্ত্র্য কিংবা শারীরবৃত্তীয়ভাবে নির্ধারিত একজন ব্যাক্তির বৈশিষ্ট্য, যা অপরিবর্তনীয়। ক্রোমোজোম, ব্যাক্তির জননাঙ্গ, হরমোনের প্রভাব প্রভৃতির ভিত্তিতে সেক্স নির্ধারিত হয়। সেক্স সাধারণত তিন প্রকার-

(১) স্ত্রী (Female): জরায়ু, ক্রোমোজোম XX, উচ্চ মাত্রায় ইস্ট্রোজেন হরমোন ইত্যাদি বিদ্যমান।

(২) পুং (Male): পুং জননাঙ্গ, XY ক্রোমোজোম, উচ্চ মাত্রায় টেস্টোস্টেরন হরমোন ইত্যাদি বিদ্যমান।

(৩) আন্তঃলিঙ্গ (Intersex): পুং কিংবা স্ত্রী জননাঙ্গের চেয়ে ভিন্নধর্মী জননাঙ্গ, যৌথ প্রজননতন্ত্র অথবা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত প্রজননতন্ত্র, হরমোন ক্ষরণের মাত্রার বিভিন্নতা বিদ্যমান।

জেন্ডার কি?

কোনো ব্যাক্তি সে মানসিকভাবে নিজেকে যে লিঙ্গের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করে বা নিজস্ব লিঙ্গসংক্রান্ত অনুভুতি বুঝাতে যে পরিচয় ধারণ করে তাই জেন্ডার। আমরা সাধারণত জেন্ডার বলতে শুধুমাত্র নারী-পুরুষ এই দুটি প্রপঞ্চ বুঝে থাকি। কিন্তু জেন্ডার কোনো ব্যাক্তির দৈহিক গঠনতন্ত্র ধারা নির্ধারিত হয় না, একজন ব্যাক্তি নিজেকে মানসিকভাবে কি অনুভব করে তার মাধ্যমেই জেন্ডার নির্ধারিত হয়। একজন ব্যাক্তির পোষাক-পরিচ্ছেদের ধরণ, আচার-আচরণের প্রকৃতি জেন্ডারের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অধিকন্তু সমাজে একজন ব্যাক্তির ভূমিকা কি হবে তাও জেন্ডার নির্ধারণ করে দেয়। যেমন- প্রচলিতভাবে আমাদের সমাজে নারী শুধু গৃহে কাজ কিংবা সন্তান লালন-পালন করবে, অথবা পুরুষ শুধু বাড়ির বাইরে কাজ করবে-আয় রোজগার করবে। তাই জেন্ডার সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত হয়। জেন্ডার ধরনের দিক থেকে পৃথিবীতে নানা ধরনের জেন্ডার রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি জেন্ডার সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো-

(১) রূপান্তরিত লিঙ্গ (Transgender): জন্মসূত্রে প্রাপ্ত লিঙ্গের সাথে দ্বিমত পোষণ করে নিজেকে অন্য জেন্ডারের আওতায় ফেলে। যেমন: কোনো ব্যক্তি যদি পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও নিজেকে নারী পরিচয়ে সম্বোধন করে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিবর্গ জন্মসূত্রে নারী বা পুরুষ থেকে ভিন্নতা লাভ করে, কিংবা স্বেচ্ছায় নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে থাকে।

(২) সিসজেন্ডার (Cisgender): কোনো ব্যক্তি যখন জন্মসূত্রে প্রাপ্ত লিঙ্গ অনুযায়ী নিজের জেন্ডার বাছাই করে, তখন তাকে সিসজেন্ডার বলে। যেমন- পুরুষাঙ্গ-নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তি যখন নিজেকে পুরুষ পরিচয়েই সম্বোধন করে।

(৩) জেন্ডার-ফ্লুয়িড (Gender fluid):  যে ব্যক্তির কোন নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয় নেই, যার লিঙ্গ পরিচয় সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। তারা যেকোন সময় যেকোন পরিচয় কিংবা জেন্ডার পরিচিতি ছাড়াই বেঁচে থাকতে ভালোবাসে।

(৪) জেন্ডার নিউট্রলঃ যদি কোনো ব্যাক্তি মনে করেন যে তিনি পুরুষ কিংবা নারী কোনোটাই নয়, তখন তিনি জেন্ডার নিউট্রল হিসেবে পরিচিত হবেন।

সেক্স এবং জেন্ডারের পার্থক্য কোথায়?

সমাজবিজ্ঞানী অ্যান ওকলের মতে, সেক্স শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করে আর জেন্ডার একটি নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত। একটি সমাজে একজন ব্যাক্তির আচার-আচরণ কেমন হবে, তার পোশাক-পরিচ্ছদ কি রকম হবে, সমাজে তার ভূমিকা কি হবে, মানসিক গঠনের দিক দিয়ে একজন ব্যাক্তি কি রকম হবে তা জেন্ডার নির্ধারণ করে দেয়। মূলত জেন্ডারের মাধ্যমে একজন ব্যাক্তির পরিচয় সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্মিত হয়। যেমন- বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিতভাবে নারীর ভূমিকা গৃহে কাজ করা, সন্তান লালন-পালন করা। অন্যদিকে  আয় উপার্জন, বিচার, সালিস, রাজনীতি ইত্যাদি বাইরের কাজ হলো পুরুষের। আবার বাংলাদেশে বসবাস করা গারো জনগোষ্ঠীদের ক্ষেত্রে তারা মাতৃতান্ত্রিক। নারীরা পরিবারের প্রধান এবং পরিবারে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই জেন্ডার পরিবর্তনশীল। একেক সমাজে জেন্ডার একেক ভূমিকা নির্মাণ করে। আবার আমাদের মনে রাখতে হবে, জেন্ডার কিন্তু সেক্সের পরিণতি নয় অর্থাৎ আপনি পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে পুরুষ বলে আপনি গৃহের কাজ করতে পারবেন না বা সন্তান-লালন পালন করতে পারবেন না এমন কোনো কথা নেই। অন্যদিকে আপনি নারী বলে আপনাকে সারাজীবন গৃহেবন্ধী হয়ে গৃহে কাজ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাই জেন্ডার ধারণা সামাজিক ভাবে নির্মিত নারী-পুরুষের ভিন্নতা বা স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে।

অন্যদিকে সেক্স প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে সৃষ্ট একজন ব্যাক্তির বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্নতা প্রকাশ করে। সেক্স অপরিবর্তনশীল। যে ব্যাক্তি পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, জেন্ডারের ভিত্তিতে হয়তো তার একেক সমাজে একেক ভূমিকা হতে পারে কিন্তু সে পৃথিবীর যে জায়গায় থাকুক বা যে জায়গায় যাক তার পুরুষাঙ্গ, পুরুষাঙ্গই থাকবে। তাই সেক্স প্রাকৃতিক এবং জন্মগতভাবে নির্ধারিত হয়। সুতরাং সেক্স সার্বজনীন।

মোটকথা হচ্ছে, সেক্স অপরিবর্তনশীল, সার্বজনীন, শারীরিক বা জৈবিক এবং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। আর জেন্ডার পরিবর্তনশীল, সমাজ-সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন হতে পারে, নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত হয়।

 324 total views,  2 views today

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *