হীরক রাজার দেশে: স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প
Shagatom Chakma
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর অমর সৃষ্টি “গুপি গাইন ও বাঘা বাইন” এই দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় সত্যজিৎ রায়ের “হীরক রাজার দেশে” চলচ্চিত্রটি। ১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের ছোটদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র “গুপি গাইন বাঘা বাইন” মুক্তি পাওয়ার পরে সত্যজিৎ রায় “হীরক রাজার দেশে” নামে একটি সিকুয়েল তৈরি করেন। “হীরক রাজার দেশে” চলচ্চিত্রটি “গুপি গাইন বাঘা বাইন” সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব যা ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মুক্তি পায়।

সত্যজিৎ রায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক অনবদ্য গল্প হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। চলচ্চিত্রে মূলত সত্যজিৎ শোষিতের সঙ্গে শাষকের সংঘাতের চিত্র তুলে ধরেছেন। চলচ্চিত্রে সকল সংলাপ ছড়ার আকারে তুলে ধরা হয়েছে, এটি এই চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দিক। তবে চলচ্চিত্রে উদয়ন পন্ডিত এবং গুপি-বাঘা ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তবে চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে গুপি-বাঘা ছড়ার ভাষায় কথা বললেও শুন্ডীর রাজ প্রাসাদ থেকে বেরোনোর পরে তারা আর ছড়ার ভাষায় কথা বলেন নি। চলচ্চিত্রে ছড়ার ভাষায় কথা না বলাকে মুক্ত চিন্তার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কেননা চলচ্চিত্রের বাকী চরিত্র সবাই ছড়ার আকারে কথা বলেছে এবং তাদের চিন্তা একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। “হীরক রাজার দেশে” চলচ্চিত্রের একটি গান “কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়” যেটি চরণদাস নামে একটি চরিত্র উপস্থাপন করেছিল। দর্শক সেই গানের মধ্যে পুরো সিনেমার চিত্র অনুভব করতে পারবে। তার কিছু লাইন নিম্নে উল্লেখ্য:
“দেখো ভাল-জনে রইল ভাঙা ঘরে
মন্দ সে যে সিংহাসন চড়ে।।
ও ভাই, সোনার ফসল ফলায় যে তার
দুই বেলা জোটে না আহার।।
হিরার খনির মুজুর হয়ে
কানা-কড়ি নাই,
ও ভাই হিরার খনির মুজুর হয়ে
কানা-কড়ি নাই
ও তার কানা-কড়ি নাই।
ওরে ভাই রে, ওরে ভাই রে, ভাইরে
আমি কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়
ওরে ভাইরে, ভাইরে
কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।“

চলচ্চিত্রটি শুরু হয় শুন্ডি রাজ্যর রাজার জামাই গুপি গাইন ও বাঘা বাইনের গান নিয়ে। তাদের না ছিল চুলা, না ছিল চাল কিন্তু আজ তারা ভূতের রাজার আশীর্বাদে শুন্ডি রাজ্যর রাজার জামাই, যেখানে ইচ্ছা সেখানে মুহুর্তের মধ্য চলে যেতে পারে, তারা দুজনে গান করলে তাদের সামনে থাকা কেউই নড়তে-চড়তে পারে না। এইগুলো গুপি-বাঘা চরিত্রের বিশেষ দিক। চলচ্চিত্রে হীরক রাজার পতনের ক্ষেত্রে তাদের অনন্য ভূমিকা দর্শক চলচ্চিত্রে দেখতে পাবে। শুন্ডির রাজ প্রাসাদে গত দশ বছর ধরে শুয়ে-বসে দিন যাপন করতে গিয়ে গুপি-বাঘা দুজনেই বিরক্ত, তাদের দেশ ভ্রমণে ইচ্ছে হলো।গুপি বাইন গান শুরু করলো:
“চলো যায় ঘুরে, আসি প্রাণভরে
বনেতে-পাহাড়ে-মরু প্রান্তরে”
সেই মুহুর্তে তাদের শুশুর গুপি-বাঘাকে হিরক রাজ্যর ১লা আশ্বিনে বর্ষ ফূর্তি উৎসবে যাওয়ার নিমন্ত্রণ দিলো। এদিকে হীরক রাজ্যে বর্ষ ফুর্তি উৎসব নিয়ে পরিকল্পনার শেষ নেই। উৎসবের আর সবে এক মাস বাকি! রাজ্যে খাজনা আদায় চলছে। উৎসবের দিন থেকে শুরু হবে হিরকাব্দ। হিরক রাজ্যর গবেষক “মস্তিষ্ক প্রক্কালক” নামে মগজ ধোলাইয়ের এক বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছেন। গবেষককে হিরক রাজা হাস্য-রসাত্মক ভাবে “গবেষক গবুচন্দ্র জ্ঞানতীর্থ জ্ঞানাম্বুধি জ্ঞানচূড়ামণি” বলে সম্বোধন করে থাকেন। রাজার মতের বিরুদ্ধে যে কথা বলবে, তাকে গবেষকের তৈরি করা যন্তরমন্তর ঘরে নিয়ে গিয়ে মগজ ধোলাই করা হয়।

যন্তর-মন্তর ঘরে ব্যাক্তিকে যা শিখানো হয় তাই সে বুলি আওড়াতে থাকে। হিরক রাজা মগজ ধোলাইয়ের জন্য সভাকবিকে তিনটি মন্ত্র লিখতে বললেন- কৃষকের মন্ত্র, শ্রমিকের মন্ত্র, শিক্ষকের মন্ত্র। হিরক রাজা মনে করেন অভিযোগ দেওয়া গরিবের রোগ। রাজার কাছে তিনজন লোক অভিযোগ দিতে আসে। তাদের মধ্যে কৃষক ফজল মিয়া অভিযোগ দিতে আসলে রাজার সভাকবি তাকে মন্ত্র পড়িয়ে শোনান-
‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’,
‘ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেয়া চাই’,
‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’
রাজার কাছে এক খনির শ্রমিক অভিযোগ দিতে আসলে তাকেও মন্ত্র শোনানো হয়।
‘যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম’,
‘অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ’,
‘ধন্য শ্রমিকের দান, হীরকের রাজা ভগবান’
এই দুইজনকে যন্তর মন্তর ঘরে নিয়ে মগজ ধোলাই করা হয়। এভাবে যারা রাজার মতের বিরুদ্ধে যাবে তাদের এভাবে মগজ ধোলাই করা হতো। বাকী অভিযোগকারী সংগীত শিল্পীকে বনের মধ্যে গর্তের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। এই চিত্রায়নের মাধ্যমে রাজার স্বৈরাচারীতা এবং অনাচার ফুটে ওঠে।
হিরক রাজা পাঠশালা বন্ধের উদ্যেগ নেয়। হিরক রাজা মনে করেন, যে যত বেশি জানে, সে তত কম মানে। রাজা তার প্রজাদের শিক্ষাদান থেকে দূরে রেখে তার ক্ষমতাকে আরো স্থায়ীত্ব করতে চাই। কেননা রাজা মনে করে মূর্খ কেউ তার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে না। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পাঠশালায় গিয়ে পাঠশালা বন্ধ করে দেন। সভাকবি পাঠশালায় শিক্ষকের মন্ত্র পড়িয়ে শোনান:
‘লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে’,
‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’।

পাঠশালার শিক্ষক উদয়ন পন্ডিতকে পাঠশালা বন্ধ করতে হয় এবং রাজার পেয়াদারা উদয়ন পন্ডিতের সব বই পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। উদয়ন পন্ডিতকে রাজ্য ছেড়ে পালাতে হয়। চলচ্চিত্রে সবাই ছড়ার ছন্দে সংলাপ বললেও উদয়ন পন্ডিত ছড়ার ছন্দে কথা বলে নি। এর ফলে উদয়ন পন্ডিতকে চলচ্চিত্রে মুক্ত চিন্তার, অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক শক্তি হিসেবে দেখা যায়। উদয়ন পন্ডিত হয়ে উঠে রাজা হীরকের সবচেয়ে বড় শত্রু। হীরক রাজা হীরের লোভ দেখিয়ে রাজ্যের সকলকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখে। কেউই রাজা হীরকের বিরুদ্ধে কথা বলবার সাহস পায় না। সবার মুখে মুখে একটাই কথা।
“যাই যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান”।
একদিন উদয়ন পন্ডিত আর গুপি-বাঘার বনের মধ্যে দেখা হয়। উদয়ন পন্ডিত গুপি-বাঘার কাছে হিরক রাজ্যর রাজার মূল চরিত্র তুলে ধরেন। হীরক রাজা তার স্বৈরাচারীতা বাইরের লোককে জানতে দেয় না। দিনের পর দিন কিভাবে রাজা হিরক অনাচার-অত্যাচার করে চলেছেন তা উদয়ন পন্ডিত গুপি-বাঘার কাছে তুলে ধরেন।
বর্য ফূর্তি উৎসবের দিন চলে এলো। গুপি-বাঘা হীরক রাজ্যে রাজ অতিথি হয়ে প্রবেশ করলো। উদয়ন পন্ডিতের কথা মতো তারা রাজ্যের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে শুরু করলো। একদিন উদয়ন পন্ডিত হীরার খনিতে বাঘার জুতার তলায় একটি চিরকুট দেয়, মূলত সেই চিরকুটের মধ্যে দিয়ে হীরক রাজার পতনের মূল পরিকল্পনা হয়। উদয়ন পন্ডিতের ভাষ্যমতে রাজ্যের সকল পেয়াদা ঘুষ খায়, তাদেরকে হীরা দিয়ে কৌশলে তাদের দলে নিয়ে আসতে হবে এবং তিনি কৃষক-শ্রমিকদের তার পক্ষে নিয়ে এসেছেন। উদয়ন পন্ডিত গুপি-বাঘাকে রাজ ভান্ডারের হীরা লুট করে নিয়ে আসতে এবং কৌশল মত “কাল ভৈরবের” মন্দিরে তাদের চলে আসতে বলে। গুপি-বাঘা রাজ ভান্ডারের হিরা লুট করে, রাজ পেয়াদাদের হিরা ঘুষ দিয়ে নিজেদের দলে নিয়ে আসে। কিন্তু গুপি-বাঘা “কাল ভৈরবের মন্দীরে” এলে সেখানে উদয়ন পন্ডিতের দেখা পায় নি এবং রাজার পেয়াদারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে বলেই তাদের অনুমান হয়।
হিরক রাজা উদয়ন পন্ডিত এবং তার ছাত্রদের ধরে নিয়ে যায়। অন্যদিকে গুপি বাঘা যন্তর-মন্তর ঘরে গিয়ে গবেষককে হীরার লোভ দেখিয়ে তাদের দলে নিয়ে আসে এবং মগজ ধোলাই মেশিনে রাজার জন্য মন্ত্র তৈরি করা হয়। এরপরে, রাজা উদয়ন পন্ডিত এবং ছাত্রদের যন্তর মন্তর ঘরে নিয়ে আসে মগজ ধোলাই করার জন্যে, কিন্তু গবেষক গুপী বাঘার দলে থাকায় তাদের মগজ ধোলাই মেশিনে প্রবেশ করালেও মগজ দোলাই মেশিন কাজ করে নি। এরপরে গুপি বাঘা বের হয়ে আসে এবং বাঘা রাজার দলে থাকা পেয়াদাদের হীরা দিয়ে তার দলে নিয়ে আসে। পরে উদয়ন পন্ডিতরা মগজ ধোলাইয়ের ঘর থেকে বের হয় এবং উদয়ন পন্ডিত রাজাকে বলেনঃ
অনাচার করো যদি, রাজা তবে ছাড়ো গদি/
যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারি/
গরিবে শোষণ পাপ, ক্ষমা চেয়ে নাহি মাপ/
নাহি কোনো পরিত্রাণ, হীরকের রাজা শয়তান।‘
পরবর্তীতে রাজা হীরককে, তারই মগজ ধোলাই মিশনে তাকে আর তার মন্ত্রীদের মগজ ধোলাই করা হয়। এদিকে উদয়ন পন্ডিতের নেতৃত্বে রাজার মূর্তি দড়ি দিয়ে টেনে নিচে নামানোর কাজ শুরু হয়। শ্লোগান দেয়া হয়ঃ
“দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান”

সেখানে এক পর্যায়ে হিরক রাজা নিজেই যোগ দেয় দড়ি ধরে মূর্তি নামাতে। সেখানে মগজ ধোলাই হওয়া কৃষক ফজল মিয়া আর খনির শ্রমিক বলরাম দাঁড়িয়ে থাকলে, গুপী বাঘা তাদেরো সেখানে অংশগ্রহণের জন্য ধরে নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে, স্বৈরাচারী রাজাকে ক্ষমতার গদি থেকে নামাতে সকলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া সংগ্রাম আর কৌশলের কথা তুলে ধরেছেন। একটা বিপ্লব শুধুমাত্র একজন ব্যাক্তি চাইলেই সম্ভব নয়, প্রয়োজন নেতৃত্ব, প্রয়োজন সকলের অংশ গ্রহণ। ঠিক যেমনটি দর্শক চলচ্চিত্রের শেষাংশে হীরক রাজার মূর্তি টেনে নামানোর চিত্রে সকলের অংশগ্রহণ দেখতে পাবে।
2,792 total views, 2 views today