চাকমা সংস্কৃতির পরিচয়: হেঙগরঙ

Supanta Chakma


সংস্কৃতি যদি মানুষের জীবনধারা হয়ে থাকে,তাহলে এর উপাদানগুলো হলো সংস্কৃতিমনা মানুষের বহিঃপ্রকাশ। যেমন- গান নির্দিষ্ট কোন ভাষা, জাতিগোষ্ঠী কিংবা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। যার কারণে হয়তো এক ভাষার গান অন্য ভাষার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, যখন তাদের মনের অনুভুতির মধ্যে মিল খুজে পায়। এছাড়াও সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় জানা যায় আর সেই সংস্কৃতির প্রতিটি উপাদান একেক জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের বাহক হিসেবে কাজ করে।

ছবিতে হেঙগরঙ

পৃথিবীর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর  রয়েছে আলাদা আলাদা নিজস্ব সংস্কৃতি ও উপাদান। তেমনি চাকমা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির একটি উপাদান বা বাদ্যযন্ত্রের নাম হলো ’হেঙগরঙ’। এটি সম্পূর্ণ চাকমা জনগোষ্ঠীর একটি নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র। এই যন্ত্রের তৈরির পদ্ধতি এবং উপাদান, বাজনা, সুর ও সুরের গভীরতার মাধ্যমে তাদের বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে। হেঙগরঙের সুর এক ধরণের অনুভূতির সৃষ্টি করে যা নিজে না শুনলে অন্যকে বোঝানো সম্ভব নয়। যার কারণে হয়ত এটি আদিবাসীদের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে।

চাকমা জনগোষ্ঠী সচরাচর পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে আসছে। যার কারণেই সেই আদিকাল থেকে প্রকৃতির সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক এবং প্রকৃতির প্রতিটি জিনিসকে তারা যথাযত ব্যবহার করতে শিখেছে। “হেঙগরঙ” তৈরিতেও এই দিকটি বেশ লক্ষ্য করা যায়। “হেঙগরঙ” সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরী করা হয়। তবে ভালো মানের “হেঙগরঙ” তৈরির জন্য লাগে পাকা মিদিঙ্গে বাশ (বাংলায়-মিতিঙ্গা বাঁশ)।  এটি তৈরির জন্য প্রথমে দরকার একটি পাকা বাঁশ। তারপর বাঁশটির পাতলা একটি অংশ নিয়ে খুব সহজেই তৈরি করা যায়। অতীতে যে কেউ এটি তৈরি করতে পারতো কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবহার কমে যাওয়ায় খুব কম লোকই এটি তৈরি করতে জানে। তাই ভালো মানের হেঙগরঙ তৈরির জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের দরকার।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ছোট্ট এই  জিনিসটি কিভাবে, কখন, কে, কেন বানালো, কিভাবে মাথায় আসলো ইত্যাদি। এর উত্তর খুজতে গেলে প্রথমে জানতে হবে আদিকালে চাকমাদের জীবন ব্যবস্থা। প্রযুক্তির ছোঁয়া তখনো অনেক দূরে, তাদের ছিল না কোন বর্তমান সময়ের মত বিনোদনের মাধ্যম। তাছাড়া অধিকাংশ মানুষের জীবন জুম চাষ নির্ভর হওয়ায় পাহাড়ের চূড়ায় অস্থায়ী জুম ঘর/ টং ঘর তৈরি করে সেখানে বাস করতো। সামনে থাকতো ’ইজোর’ ( যা দেখতে অনেকটা বারান্দার মত তবে অনেক উচু)। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতের আকাশে যখন চাঁদ মৃদু আলো ছড়িয়ে দিত, তখন ’ইজোরে’ বসে হেঙগরঙ বাজিয়ে সুরের সাথে মৃদু বাতাসে ক্লান্তিগুলো ছড়িয়ে দিত।  বাতাসের ছোঁয়া আর হেঙগরঙের সুরের মাধ্যমে সৃষ্ঠ এক অপূর্ব অনুভূতির জাগানিয়া ছিল একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। পুরুষ মহিলা সকলে “হেঙগরঙ” বাজাতে পারত। শুধু তাই নয় বিভিন্ন পালাগান,যাত্রাপালা কিংবা বিঝু উৎসবে হেঙগরঙ বাজানো হতো। 

সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক যন্ত্রপাতি আগমনের ফলে এর কদর কমতে থাকে। বর্তমানে এর ব্যবহার অতি নগণ্য। যদিও কিছু মানুষ হেঙগরঙ্কে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে। তবে এর সংখ্যা অনেক কম। কারণ বর্তমান হাইব্রিড সংস্কৃতি কিছু আদিম এবং ঐতিহাসিক জিনিসকে গ্রাস করেছে।যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে আদিবাসীদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক জিনিস। এর পাশাপাশি সকলের অনুধাবন করা উচিৎ, যে জিনিসটি আদিপুরুষদের সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাদের অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করে এবং একটি জাতিগোষ্টির আদি পরিচয় বহন করে তার গুরুত্ব কতটুকু! 

 572 total views,  2 views today

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *