ব্ল্যাক ক্রিপার ও হাড়ভাঙ্গার পাহাড়ী চিকিৎসার পদ্ধতি

Supanta Chakma

বর্তমান সময়ে মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া একদিনও চলতে পারে না। একদিন মোবাইল ব্যবহার না করলে মনে হয়, কেউ যেন অক্সিজেন কেড়ে নিলো। আমরা কি ভেবে দেখেছি মোবাইল আবিষ্কার হওয়ার আগের দিনগুলো কিভাবে চলতো? কিংবা তখন আমাদের জন্ম হলে আমরা কিভাবে দিন পার করতাম? বর্তমানে বিজ্ঞানের বদৌলতে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। আগে মানুষ সামান্য অসুখ হলেই  মারা যেতো কিন্তু বর্তমানে মানুষের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। একবার ভাবুন তো চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হওয়ার আগে মানুষ যখন খাবারের সন্ধানে বনে জঙ্গলে খাবার সংগ্রহ করতে যেত, বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করতে পিছু পিছু দৌড়াত,  দুর্ভাগ্যবশত কোন দুর্ঘটনায় শরীরের কোন অংশের হাড় ভেঙ্গে গেলে  তারা কিভাবে চিকিৎসা করতো? তখন কি ওখানেই মারা যেতো? কিংবা পঙ্গু হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হতো? নাকি পরিবারের বোঝা হিসেবে মেরে ফেলা হতো? 

হ্যাঁ, লোকটির চিকিৎসা হতো। তবে সেটা হতো সম্পূর্ণ প্রকৃতিক চিকিৎসা / পাহাড়ি চিকিৎসা। এই চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ হতো এবং স্বাভাবিক মানুষের মতোই হাঁটতে পারতো। বাংলাদেশে এই ধরনের চিকিৎসা সচারাচর পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায়। বিশেষকরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসরত পাহাড়ি আদিবাসীদের মধ্যে।

আশ্চর্য!  এটি আবার কেমন চিকিৎসা। জেনে রাখা ভালো যে বর্তমানে আমরা যেসব ডাক্তারি ঔষধ খেয়ে থাকি কিংবা ব্যবহার করে থাকি সেগুলোর প্রধান উপাদান কিন্তু প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঔষধি গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। আমরা হয়ত জানিই না যে আমাদের চারপাশে কতো রকমের প্রয়োজনীয় এরকম অনেক ঔষধি গাছ আছে। যেগুলো আমাদের অনেক উপকার করে থাকে। যেমন-প্যারাসিটামল তৈরি হয় সিঙ্গোনা গাছ থেকে। ঠিক একইভাবে পাহাড়ি জঙ্গলে এক ধরনের ঔষধী লতার পাতা পাওয়া যায়।  যেটি স্থানীয়দের কাছে “হাড়ভাঙ্গা” ঔষধ নামেই পরিচিত। এই লতার পাতা দিয়েই ভেঙ্গে যাওয়া হাড় জোড়া লাগাতে চিকিৎসা করা হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে এই চিকিৎসা যারা করে থাকে, তাদের নেই কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উচ্চতর ডিগ্রি, নেই কোন বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি। কিন্তু সুস্থ হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। তাহলে কিভাবে পেলো এই চিকিৎসার সন্ধান? এর পেছনে একটা ছোট্ট কাহিনী আছে।

জনশ্রুতিতে জানা যায় যে,  অতীতে পাহাড়ি এলাকায় যখন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, তখন বেশির ভাগ মানুষই জুম চাষ করতো। এসব জুমে চাষ করা হতো নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক শাক-সবজি, বিভিন্ন ফসল,ধান ইত্যাদি। এসব জুমে খাবার খাওয়ার জন্য আসতো বিভিন্ন পশুপাখি। যেমন- হরিণ, শেয়াল,বন্য মুরগি, বন্য শুকর,হাতি ইত্যাদি। একদিন গ্রামের মানুষ দল বেঁধে হরিণ ধরতে গেলো। একদিকে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হলো এবং অন্যদিক থেকে সবাই হরিণকে তাড়া করতে লাগল। এভাবে একসময় হরিণ জালে আটকা পড়ে যায় এবং মেরে ফেলা হয়। তারপর সবাই মিলে হরিণের মাংস ভাগাভাগি করে নিল। সে সময়ে ছিল না কোন প্লাস্টিকের ব্যবহার, ছিল না বাসন কোসনের সহজলভ্যতা। যার কারণে অনেকে তাদের ভাগের অংশটুকু গাছের বিভিন্ন পাতা দিতে মুড়িয়ে নিলো। পাতা দিয়ে মোড়ানোর পর অনেকে অনেক ধরনের লতা দিয়ে বাঁধল। অনেকে সেই অজানা লতা দিয়ে বেধে মাংসের ভাগ বাড়িতে নিয়ে আসল এবং সারারাত বাধা অবস্থায় রেখে দিল। পরের দিন পাতা আর লতা দিয়ে মোড়ানো মাংস ভাগটি খুলে দেখা হলে দেখা যায় যে, মাংসের টুকরাগুলো জমাট বেধে রয়েছে। তখন ভাবতে লাগল এটি আসলে কি? কি তার গুণ যে মাংসের হাড়্গুলো জোড়া লাগাতে সক্ষম। পরে সেটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলো। সেই থেকে এই অজানা লতাটি হাড় ভাঙ্গার ঔষধ হিসেবে পরিচিতি পেল।

সেই থেকে এটি হাড়ভাঙ্গা ঔষধ নামেই চিনতে শুরু করল।  এর বাইরে নির্দিষ্ট কোন নাম দেয়া হয়নি। বৈজ্ঞানিকভাবে যদি শ্রেণি বিন্যাস করা হয়  তাহলে এর নাম হলো Ichnocarpus frutescens”এটি Apocynaceae পরিবারের অন্তর্গত।  ইংরেজিতে বলা হয় “ব্ল্যাক ক্রিপার” (Black Creeper)। এটি মূলত চীন, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়।  এটি অনেকটা গুল্ম জাতীয়। তবে পুস্পলতাও বলা যায় যেটি প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর বাকল থেকে আটালো রস বের হয়। পাতাগুলো লম্বায় ৬ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৪.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। মূলের রং অনেকটা লালচে । হাড় ভাঙ্গা ছাড়াও এটি বাত, হাঁপানি, কলেরা ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যায়।

ভাঙ্গা হাড়কে জোড়া লাগানোর জন্য মূলত এই লতার পাতাকে দুই পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়। প্রথমে এই লতার পাতাগুলোকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর পাতাগুলোকে কুচি কুচি করে গুড়ো করার পর পেস্ট তৈরি করা হয়। এই পেস্টকে হাল্কা গরম করে ভাঙ্গা স্থানের চারিদিকে ঘন করে লাগানো হয়। লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হয়, যাতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে এবং কাপড় দিয়ে বেধে দেয়া হয়। এভাবে প্রথম পর্যায়ে ২-৫ দিন রাখতে হয়।

দ্বিতীয় ধাপে একইভাবে পাতার পেস্ট তৈরি করে ঠান্ডা অবস্থায় লাগাতে হয়। এই পর্যায়ে বাধা অবস্থায় রাখতে হয় ৫-৭ দিন। এভাবে দুইধাপে রাখার পর মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে হাড় জোড়া লেগেছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্তও রাখা যায়। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার জন্য এক মাস কিংবা তার অধিক সময় লাগতে পারে। তবে অতিরিক্ত ভেঙ্গে গেলে আরো বেশি সময় লেগে যায়।

এখানে আরো উল্লেখ্য, যে হাড় ভাঙ্গার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঔষধ লাগালে তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে ১০-১৫ দিন পর হলেও লাগানো যায়। এক্ষেত্রে সুস্থ হতে অনেক সময় লেগে যায় এবং ধীরে কাজ করে। এরকম হয়তো অনেক চিকিৎসা পদ্ধতি আছে যা সাধারণ মানুষ জানে না কিংবা প্রজন্মভেদে সচেতনার অভাবে হারিয়ে গেছে অনেক তথ্য। এ ধরনের প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো তাদের দ্বারাই সম্ভব যারা প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে প্রকৃতিকে করে নিয়েছে আপন। যার ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিও তাদের দিয়েছে নিরন্তর ভালোবাসা।

 রেফারেন্স- https://en.wikipedia.org/wiki/Ichnocarpus_frutescens

 344 total views,  2 views today

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *