বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন: শহীদ সুদেষ্ণা সিংহের কথা

Shagatom Chakma

ভারতের আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার শিলচড়ে বাংলা ভাষার অধিকারের আন্দোলনে ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো জন বীরশহীদ আত্মহুতি দেন এবং তাদের মধ্যে নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে কমলা ভট্টাচার্যই প্রথম নারী ভাষা শহীদ। তার ঠিক ৩৫ বছর পরে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী” ভাষা স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে শহীদ হন বত্রিশ বছর বয়সী সুদেষ্ণা সিংহ। সুদেষ্ণা সিংহ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী ভাষা শহিদ এবং আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম ভাষা শহীদ। বাংলাদেশ-ভারত উভয়প্রান্তের বিষ্ণুপুরী মণিপুরীভাষী মানুষ প্রতিবছর রক্তঝরা ১৬ মার্চকে স্ব-ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ‘শহীদ সুদেষ্ণা দিবস’ হিসাবে পালন করে থাকে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ভাষাভাষীর প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের এই অধিকার না থাকায় জন্ম নেয় ভাষা আন্দোলনের। ১৯৫৫ সালের শুরু থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষা অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৫৫ সালের “নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা”র মধ্যে দিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বাকৃতি এবং ভাষা অধিকারের দাবিতে ভাষা পরিষদের উদ্যেগে গড়ে উঠে “সত্যাগ্রহ আন্দোলন”। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষন, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন।

সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ রেল অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনে রাষ্ট্রের নৃশংস বন্দুকের গুলিতে শহীদ হন বিলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। সুদেষ্ণা সিংহ হলেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী ভাষা শহীদ এবং আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম ভাষা শহীদ।

২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় বরাক উপত্যকার প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু হয়। বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড়, পাথারকান্দি, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, ত্রিপুরা রাজ্য এবং মণিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সংখ্যাধিক্য। বাংলাদেশে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের অধিক বসতি দেখা যায়। মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ছাড়াও দেশের অনেক জায়গাতেই নানান প্রয়োজনে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগণ নিজেদের ঐতিহাসিক আবাস গড়ে তুলেছেন। 

তথ্যসূত্রঃ

 ১। বরাক-উপত্যকার মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপঞ্জি (১৯৫৫-১৯৯৬) – পাভেল পার্থ

২। A Tribute to SUDESHNA: One of the two great woman in human who laid down their lives for mother tongue.

৩। https://www.prothomalo.com/bangladesh/%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8

 535 total views,  2 views today

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *